আতাউস সামাদ
আজ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেনাশাসক, হৃত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধান, সংস্কারক, উন্নয়নকর্মী ও কূটনীতিবিদ এসব পরিচয়ে বিভিন্ন সময়ে পরিচিত হয়েছেন এবং প্রতিটি চরিত্রেই তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে আজও প্রায়ই তর্কের ঝড় ওঠে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দুই বছর অযাচিত বিরতি দিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের নেতারা মরহুম জিয়াউর রহমানকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করে আসছেন। আর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বাতিল হওয়ার পর থেকে ওই সমালোচনা অধিকতর উচ্চমাত্রা পেয়েছে। তবুও আজ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে যদি শুধুই তাঁর কিছু ভালো কাজ ও সাফল্যের কথা উল্লেখ করি আশা করি তাহলে সদয় পাঠক নিজ মূল্যবোধের গুণে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। এখানে বলে রাখি সাংবাদিক হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার বার-দুয়েক দেখা হয়েছে। সেই সাক্ষাত্, পরিচয়ের পর্যায়ে যায়নি। আর ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে গভীর সঙ্কটে পতিত বাংলাদেশের দায়িত্ব যখন তাঁর কাঁধে ভর করে তখনও আমি বিদেশে কর্মরত। সেজন্য কেবল একজন সাধারণ বাংলাদেশী হিসেবেই তাঁর বেশির ভাগ কাজকর্ম অবলোকন বা পর্যবেক্ষণ করেছি আমি।
শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশীদের কাছে চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ‘আমি মেজর জিয়া’ হিসেবে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশজুড়ে যখন নৃশংস দখলদার পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে বাংলাভাষীদের হত্যা করছে, সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অচেনা অশ্রুতপূর্ব এক মেজর জিয়ার কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘোষণা বারবার প্রচারিত হয়েছিল; তা দেশের বহু মানুষ শুনতে পান এবং তাদের মুখে মুখে এই ঘোষণার কথা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আমরা জানতে পারি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। এর আগে আমরা নানাভাবে জেনেছি পুলিশ ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা হানাদার পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করেছেন। মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং এতে পেশাদার সৈনিকরা যোগ দিয়েছেন। অতি অসহায় অবস্থায় অবরুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এ খবর আমাদের মনে নতুন সাহস ও প্রত্যয় এনে দেয়। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবেই আর সেই সঙ্গে থাকবে বিপ্লবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের কর্মী ও শব্দ সৈনিকের কথা।
জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ভূমিকা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫, বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পুনর্গ্রহণ। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর একাংশের বিদ্রোহ এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে তাদের দ্বারা ক্ষমতা দখল হওয়ার সময় থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী, কার্যত খণ্ড-বিখণ্ড ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রায় সারাক্ষণই নিজ জীবন ঝুঁকিতে রেখে অবিরাম পরিশ্রম করে এই সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও বেশ কিছুটা একতাবোধ ফিরিয়ে আনেন। তাঁর শাসনকালে সেনাবাহিনীতে আরও বেশ কয়েকবার ও বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে ব্যর্থ অভ্যুত্থানকারী কিছু অফিসারের হাতে নিহত হন। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা অল্পেই ভেঙে পড়ে এবং দেশ গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়; তার বড় একটা কারণ হলো যে জেনারেল জিয়াউর রহমান একদিকে সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, তাদের রেষারেষি দূর করে একাতাবদ্ধ করে এনেছিলেন এবং অন্যদিকে দেশের দায়িত্ব বহুদলীয় ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় জেনারেল জিয়া জনগণের সরাসরি ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল জিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিরোধী দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী। তা ছাড়াও সেই সময় ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত বহুদলীয় জাতীয় সংসদ কার্যকর ছিল। এই সংসদে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান মহাজোটের কয়েকটি দলের প্রতিনিধিও অংশগ্রহণ করেছিল।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই বাংলাদেশের নাগরিকদের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশী। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেখানো হয়; কিন্তু এ সমালোচনা যে তিনি এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করেছেন তা বোধহয় সঠিক নয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, জেনারেল জিয়ার আমলেই একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বিখ্যাত কবি হাসান হাফিজুর রহমানকে সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা প্রকল্প শুরু করা হয়। তাছাড়া তাঁর সময়ে রেডিও এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক প্রচারের বলিষ্ঠ ধারা ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেও সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছেন।
সরকারপ্রধান জিয়াউর রহমান দেশে খাদ্যোত্পাদন দ্বিগুণ করা এবং সেজন্য স্বেচ্ছাশ্রমে খাল সংস্কার ও পুনঃখনন এবং পাম্পের সাহায্যে নদী, বিল ও হাওর থেকে সেচের পানি সংগ্রহ করার জন্য দেশজুড়ে কর্মসূচি নেন। পল্লীবাসীকে এই লক্ষ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে এবং গ্রামভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের ধারণা প্রচার করতে জিয়াউর রহমান গ্রামাঞ্চলে পদযাত্রা করেন কয়েকবার। খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি থানায় খাদ্যগুদাম নির্মাণের কাজ শুরু হয় জিয়াউর রহমানের আমলে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করার জন্য পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও পল্লী অঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জোর উদ্যোগ নেয়া হয় তাঁর শাসনামলে। রক্ষণশীল সমাজে এ কাজটি করা কঠিন ছিল। তিনি দুই বছরে দেশের সব মানুষের মধ্য থেকে নিরক্ষরতা দূর করার কর্মসূচিও নিয়েছিলেন, তবে তা সফল হয়নি। তাঁর আমলে শিক্ষা বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য বিটিভিতে দ্বিতীয় টেরেস্ট্রিয়েল চ্যানেল চালু হয়েছিল। এরশাদ আসলে সেটা বন্ধ করে দেয়া না হলে এর বিরাট সুফল পাওয়া যেত।
ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার পর বাংলাদেশে পদ্মার পানি কমে যায়। লাগাতার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, জাতিসংঘে বিষয়টি তোলা ও দেশে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা লংমার্চ করার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সাত বছর মেয়াদি প্রথম চুক্তিটি হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলের আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা যমুনা নদীর ওপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম বিদ্যুতের সংযোগ লাইন স্থাপন। সারা দেশে পরিচিত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড তাঁর আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের যাত্রাও তাঁর সময়। এই শিল্প প্রথম থেকেই ছিল বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য মূলধন সরবরাহ করতে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার উদার করা ও রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ধীরে ধীরে ব্যক্তিমালিকানায় ফেরত দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত তাঁর সময় গৃহীত হয়। তবে তাঁর সরকারের নীতির সুবিধা নিয়ে যাঁরা ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ পরে ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিতি পান।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর শাসনকালে বাংলাদেশের একটি অর্জন এশিয়া থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী আসন লাভ (১৯৭৮)। জাপানের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এই আসন পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এতে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইসলামী সম্মেলনের উদ্যোগে গঠিত আল-কুদস কমিটির সদস্য করা হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি বাগদাদ ও তেহরান সফর করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার তাঁর উদ্যোগ পরবর্তী সময়ে সার্ক প্রতিষ্ঠায় রূপ নেয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলতেন যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ সাধনে সেতুর কাজ করবে। তাঁকে স্বীকৃতি না দিলেও ইদানীং এ এলাকায় কানেক্টিভিটির কাজ চলছে।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করে যে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছিল ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে, তার বলে আইন করে বাংলাদেশের চারটি পত্রিকা ছাড়া আর সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেই ডিক্লারেশন আইন বাতিল করেন এবং পুরনো পত্রিকাগুলো আবার প্রকাশিত হতে থাকে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পত্রিকা প্রকাশে উত্সাহ দেয়ার জন্য তিনি রাজশাহী থেকে দৈনিক বার্তা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তার আমলেই প্রেস কাউন্সিল ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা আজও প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার দাবি জানিয়ে আসছি। জেনারেল জিয়াউর রহমান শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার শিশু পার্কটিও তার আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন বেসরকারি মালিকানায় ঢাকা, রাজধানীর আশপাশে ও দেশের অন্যত্র শিশু-কিশোরদের জন্য বিনোদন পার্ক তৈরি হয়েছে অনেক। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যবসা হিসেবে, তাই এগুলোতে প্রবেশ ফি অনেক চড়া। ঢাকার শিশু পার্ক এখন স্বল্পবিত্তের ঘরের ছেলেমেয়েদের আনন্দ করার স্থান হয়ে গেছে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাশাসক হিসেবে কী করেছেন বা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাজনীতিতে তিনি কতখানি সফল বা ব্যর্থ এবং তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা করা যায় এমন কাজও তিনি কিছু করেছেন। তবে আজকে আমি ইচ্ছা করেই সেরকম কিছু লিখলাম না—এজন্য যে আজকে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। কারও মৃত্যু দিবসে তিনি যে ভালো কাজ করে গেছেন, সেগুলো স্মরণ করা এবং তাঁর মন্দ বা নেতিবাচক কাজ বা ব্যর্থতা সম্পর্কে নীরব থাকাই ভালো এবং সেটাই সৌজন্যপূর্ণ আচরণ—একথা আমাদের পূর্বপুরুষরা শিখিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান যে দ্বন্দ্বমুখর, সন্দেহপ্রবণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি ও সমাজ—তা চিরদিন থাকবে না বলেই আমাদের আশা। তখন পূর্বপুরুষদের দিয়ে যাওয়া এ শিক্ষাটি পবিত্র ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।